পূর্ণতা


পূর্ণতা


--"তুমি কি আমার মাম্মাম হবে?"
অফিসে নিজের ডেস্কে বসে কাজ করছিল,অবন্তি।এমন মিষ্টি কন্ঠ আর অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে চমকে ওঠে পাশে তাকালো।পাশে তাকিয়ে দেখলো ফুটফুটে একটা বাচ্চা মেয়ে দাড়িয়ে আছে।কি মিষ্টি! একদম পুতুলের মতো দেখতে মেয়েটা।পুতুলের পাশে রাখলে হয়তো কেউ আলাদাই করতে পারবে না।
বয়স কতই বা হবে বছর চার!অবন্তি হাত বাড়িয়ে বাচ্চাটাকে কাছে ডাকলো।
---তুমি কে মামনি? তোমাকে তো আগে কখনো দেখি নি?
বাচ্চাটা অবন্তির প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নিজে পাল্টা প্রশ্ন করলো,
---তুমি কি আমার মাম্মাম হবে? বলো না প্লিজ।তোমাকে দেখে কেন জানি আমার মাম্মাম মাম্মাম লাগে।তোমাকে কি আমি মাম্মাম বলে ডাকতে পারি?
অবন্তি কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না।এমন পরিস্থিতিতে জীবনে কখনো পড়েনি।
---চলো জেবা সোনা। তোমার পাপা তোমাকে খুঁজছে।
অবন্তি পাশে তাকিয়ে দেখে ওদের বসের পিএ নেয়াজ দাড়িয়ে আছে। অবন্তি বুঝতে পারলো মেয়েটার নাম জেবা।জেবা নেয়াজকে দেখে বললো,
---আঙ্কেল,তুমি পাপাকে গিয়ে বলো আমি মাম্মামের কাছে আছি।এখন আমি যাব না।
নেয়াজ জেবার কথা শুনে হা করে অবন্তির দিকে তাকিয়ে আছে।অবন্তি অসহায় দৃষ্টিতে নেয়াজের দিকে তাকিয়ে রইলো।তারপর নেয়াজ অনেক বুঝিয়ে ও জেবাকে নিতে না পেরে চলে গেল। নেয়াজ যাওয়ার পর অবন্তি জেবার গালে হাত রেখে বললো,
---তোমার পাপার নাম কি মামনি?
জেবা খিলখিল করে হেসে উঠে বললো,
---তুমি কি বোকা মাম্মাম! পাপার নামও জানো না।আমার পাপার নাম জাবির চৌধুরী।
বলেই আবার হাসি শুরু করলো।অবন্তি এবার বুঝলো এটা ওদের অফিসের বস জাবির স্যারের মেয়ে।কিন্তু স্যার এর যে মেয়ে আছে তা অবন্তির জানা ছিল না।আর জানবেই বা কি করে ও তো মাত্র দুদিন হলো অফিসে কাজ শুরু করেছে।অবন্তি এবার জেবার দিকে তাকালো। মেয়েটা একমনে ওর কোলে বসে চকলেট খাচ্ছে।
---আচ্চা,জেবা তোমার মা কোথায়?
জেবা শক্ত করে অবন্তিকে জড়িয়ে ধরে বললো,
---তুমিই তো আমার মাম্মাম। তোমার গায়ে কেমন মাম্মাম মাম্মাম গন্ধ।
অবন্তি এখন কি করবে কিছুই মাথায় ঢুকছে না।তাই চুপচাপ জেবা কে জড়িয়ে ধরলো।কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি।জেবাকে জড়িয়ে ধরে অবন্তির অনেক ভালো লাগছে।কেমন শান্তি শান্তি লাগছে। কেন এমন হচ্ছে! অবন্তি বুঝতে পারছে না।হঠাৎ করে দেখলো জেবা ওর কোলে ঘুমিয়ে গেছে।অবন্তি এখন কি করবে ভেবে উঠতে পারলো না।হঠাৎ দেখলো নেয়াজ ওদের দিকেই আসছে।নেয়াজকে দেখে বললো,
---নেয়াজ ভাই দেখুন না জেবা আমার কোলেই ঘুমিয়ে গেছে।
---আচ্ছা আমার কাছে দেও।স্যার ওকে নিয়ে বাসায় যাবে এখন।
নেয়াজ যখন জেবাকে অবন্তির কোল থেকে নিয়ে যাচ্ছিল তখন কোনো এক অদৃশ্য কারনে অবন্তির মনটা কেঁপে উঠছিল।মনে হচ্ছিল ওর কোনো আপনজনকে ওর থেকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।অবন্তি এক দৃষ্টিতে নেয়াজের গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইল।
.
পরদিন অবন্তি আগে আগেই অফিসে এলো।কিন্তু কোথাও জেবা বা জাবির স্যার কে দেখতে পেলোনা।জাবির সেদিন অফিসেই এলো না।এদিকে অবন্তি চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠলো।আসলে গতকাল বাড়ি ফেরার পর থেকে অবন্তি শুধু জেবাকে নিয়েই ভেবেছে।জেবার মিষ্টি মুখটা মনে পড়ে মনে মনে অনেক হেসেছে।আজ যখন জেবাকে অফিসে পেলো না এমন কি জাবির ও এলো না তাতে অবন্তির কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগতে লাগলো।মনে মনে বলে উঠলো,"জেবা ঠিক আছে তো!"
পরপর দুদিন, না জাবির না জেবা কেউই অফিসে এলো না।অবন্তি ঠিক করে ফেললো,আজ নেয়াজকে ও জিজ্ঞাসা করবে জাবির স্যার কেন অফিসে আসে না।অবন্তি উঠে পেছনের দিকে ঘুরে থমকে দাড়ালো।জাবির ঠিক জেবার সামনে দাড়ানো।চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে।মনে হচ্ছে এতোদিন ঘুমায়নি।মাথার চুল এলোমেলো।মুখ শুকিয়ে গেছে।অবন্তির কেন যেন খুব মায়া হলো।জাবির এক দৃষ্টিতে অবন্তির দিকে তাকিয়ে আছে। অবন্তি সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিলো।জাবির কোনো কথা না বলে সরাসরি অবন্তির হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল।অফিসের সবাই হা হয়ে তাকিয়ে জাবিরের কান্ড দেখলো।অবন্তি যেন কথা হারিয়ে ফেললো।বাধা দিতে গিয়েও কোনো কারনে বাধা দিতে পারলো না।জাবির অবন্তিকে নিয়ে সোজা নিজের বাড়ি চলে এলো।গাড়ি থেকে নেমে অবন্তির হাত ধরে ভেতরে একটা রুমে নিয়ে গেলো।ভেতরে গিয়ে সামনে তাকাতেই অবন্তির মনে হলো ওর প্রানটাই বের হয়ে যাবে।জেবা বিছানায় শুয়ে আছে।কি ক্লান্ত মুখ!শুকিয়ে গেছে!দুদিনে চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে।জেবাকে দেখে অবন্তির বুকটা হুহু করে উঠলো।
---সেদিন অফিস থেকে আসার পর থেকেই এই অবস্থা।কিছু খায়নি।সারাদিন শুধু বলেছে মাম্মামের কাছে যাবো।প্রথমে আমি বুঝতে পারি নি কি বলছে আমার মেয়ে।ওর মা তো ওর জন্মের সময়ই ওকে রেখে চলে গেছে। তাহলে কার কাছে যাওয়ার কথা বলছে?পরে বুঝতে পারলাম তোমার কথা বলছে।
এপর্যন্ত বলে জাবির থামলো।অবন্তির চোখ থেকে মনে হচ্ছে পানির ঝরনা ঝরছে।চোখের পানি কিছুতেই থামছে না।অবন্তি একছুটে জেবার পাশে গিয়ে বসলো।ওকে বুকের সাথে চেপে ধরে বললো,
---মামনি দেখো,মাম্মাম এসেছে।তোমাকে ছেড়ে আর কোথাও যাবে না।
জেবা আস্তে আস্তে চোখ খুলে অবন্তিকে দেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।তারপর বললো,
---তুমি আমাকে রেখে আর কোথাও যাবে না মাম্মাম। আমি তোমার সাথে আর পাপার সাথে, একসাথে থাকবো।
অবন্তি আরো শক্ত করে জেবাকে জড়িয়ে ধরলো।যেন ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবে।
---কোথাও যাবো না মামনি।তোমাকে ছেড়ে আর কোথাও যাবো না।
.
আজ জেবার বিয়ে। অবন্তি জেবার রুমে বসে জেবাকে সাজাচ্ছে আর একটুপর পর চোখের পানি ফেলছে।জেবা মায়ের চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললো,
---মাম্মাম, তুমি সেই যে আমার বিয়ের ডেট ঠিক হওয়ার পর থেকে কেঁদে যাচ্ছ।এবার তো থামো।দেখো আমি তো কাঁদছি না।
---যেদিন মা হবি সেদিন ঠিক বুঝতে পারবি।১৮ বছর ধরে তোকে বুকে আগলে রেখেছি।তোর কথা ভেবে অন্যকোনো সন্তানও নেই নি।তুই চলে গেলে আমি কি করে থাকবো জেবা।
বলেই হুহু করে কেঁদে দিলো অবন্তি।জেবা মায়ের চোখের পানি মুছে বললো,
---মাম্মাম, একটা কবিতা শুনবে?
অবন্তিকে চুপ করে থাকতে দেখে জেবা কবিতা আবৃতি করতে শুরু করলো,
"যখন খুব একা ছিলাম
ছিল না মা আমার পাশে,
থাকবে কি করে?
আমায় ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছে দূরে!
ঠিক তখনই কোথা থেকে যেন
তোমায় পেলাম আমার জীবনে।
তুমি আমার শূন্য জীবনে এলে
পূর্ণতার ছোয়া নিয়ে।"
কবিতাটা আবৃতি করেই জেবা অবন্তিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো।
জাবির জেবা তৈরি হয়েছে কিনা দেখতে এসে,মা মেয়ের এমন দৃশ্য দেখে থমকে দাড়ালো।চোখের পানি মুছে মনে মনে বললো,"অবু তুমি আমার আর আমার মেয়ের শূন্য জীবন পূর্ণতায় ভরিয়ে দিয়েছো।এতো পূর্ণতা কি সত্যিই লেখা ছিল আমাদের ভাগ্যে??"

তানিভা তানিম

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.