ফেরা
ফেরা
“আফা, বাদাম লাগব বাদাম?”
কর্কশ চিল্লানোতে চমকে উঠলাম। সকাল থেকে কখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। আলো ঝলমলে শহরে আর সন্ধ্যা নামেনা। সন্ধ্যা নামার আগেই যান্ত্রিক আলোতে এই শহরের আনাচেকানাচে আলোকিত হয়ে উঠে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা “বাদাম, বাদাম” বলে চিল্লানো ছেলেটার দিকে তাকালাম। উসকোখুসকো চেহারা, শার্টের ভাজে ভাজে ময়লা জমে আছে, শার্টের বোতাম ভিন্ন ভিন্ন রকমের।
-বাদাম নিতে পারি কিন্তু একটা শর্ত আছে
হাত থেকে বাদামের প্যাকেটটা তার ঝুড়িতে রেখে বললো,
-বাদাম ছিল্লা দেওয়া লাগব?
-বাদাম ছিল্লা দেওয়া লাগব?
-আমাকে কি তোর বাচ্চা মনে হয়?
-তাইলে কি শর্ত?
-আজ আমার জন্মদিন। তোকে সারারাত আমার সাথে এখানে বসে গল্প করতে হবে। কেট কাটতে হবে, আমি নিজে হাতে রান্না করে এনেছি সেগুলো আমার সাথে খেতে হবে
ছেলেটা চোখমুখ কুচঁকে ফেলল। মুখের মুচকি হাসিটা মূহুর্তের মধ্যে “নাই” হয়ে গেল। আচ্ছা ছেলেটা কি আমাকে পাগল ভাবছে? আমি কি সত্যিই পাগল হয়ে যাচ্ছি? ও কি জানে সোহান নামের কোনো একজনের জন্য আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি?
-কিরে কথা বলছিস না কেনো? আয় আমার পাসে বসে যা
-আপনি কি বাচ্চা পোলাপাইন পাচার কইরা দেন?
-আপনি কি বাচ্চা পোলাপাইন পাচার কইরা দেন?
শব্দ করে হেসে দিয়ে ছেলেটাকে কাছে টেনে আনলাম। ল্যাম্পপোষ্টের নিয়ন আলোতে শহরটা আজ বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। হয়ত প্রতিটি রাত এরকম সুন্দর হয়। কিন্তু মুঠোফোনের এপাশ থেকে ওপাশে ব্যস্ত থাকি সোহানের সাথে তাই কখনো যত্ন করে দেখা হয়নি শহরটাকে। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমির ভঙ্গীমায় বললাম, হু আমি বাচ্চা পাচার করি। তোকেও পাচার করে দিব বুঝলি?
-মনে হইতাছে না আপনে বাচ্চা পাচার করেন
-কেনো?
-আপনি দেখতে ম্যালা সুন্দর। সুন্দর মানুষরা বাচ্চা পাচার করেনা
-তাহলে আর কি বস আমার পাশে। মদ-সিগারেট খাস নাকি আবার? এসব কিন্তু দিতে পারব না
-আমার কি মদ সিগারেট খাওয়ার বয়েস?
-মদ সিগারেট খাইতে বয়স লাগেনা, সঙ্গ লাগে। সঙ্গ বুঝিস? আচ্ছা বাদ দে বুঝতে হবেনা, তুই পাশে বসে যা আমার
পাশে রাখা টিফিনবক্সের দিকে তাকিয়ে আছে ছেলেটা। ল্যাম্পপোষ্টের নিয়ন আলো আমার আর ছেলেটার মাঝ বরাবর এসে পড়ছে। রাস্তার পাশের কুকুরগুলো পা দিয়ে শরীর চুলকাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরপর আমার আর ছেলেটার দিকে তাকাচ্ছে কুকুরগুলো। টিফিনবক্সে আমি সোহানের জন্য খাবার বানিয়ে এনেছিলাম। যে টিফিনবক্স সোহানের মায়া কাড়তে পারেনি সেই টিফিনবক্স রাস্তার এক মায়াহীন টোকাইয়ের মায়ার কারণ হচ্ছে৷ আমি ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছি। তার মুখ কালো করে থাকার কারণটা আমার কাছে ধোয়াশা হয়ে আছে। বারবার সে টিফিনবক্সের দিকে তাকাচ্ছে আর মুখ কালো করে বাদামের প্যাকেট নাড়াচাড়া করছে।
-কিরে কি হল?
-আমি আপনের সাথে থাকতে পারমু না। বাড়িতে মা আর আব্বা আছে। আমি আইজ ৪০ টেকা পাইছি বাদাম বেঁইচা, চাইল নিয়া গেলেই মা রান্ধা বসাইবো
মন খারাপের কারণগুলো অজানা না হলেও নিজেদের কিছু চিরায়ত স্বভাব আমাদের অজানা থেকে যায় আজীবন। এই শহরের মানুষগুলো শুধু নিজেদের ভাবনা ভাবায় ব্যস্ত। আমাদের চারপাশের হাজারটা কারণ আছে মন ভালো করার, কিন্তু ব্যস্ততা কাটিয়ে আর মনুষ্যত্ব খাটিয়ে সেই কারণগুলো খুঁজে বের করা আর হয়না।
ছেলেটার কালো করে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
ছেলেটার কালো করে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
-আমাকে নিয়ে যাবি তোর খুপড়িতে??
ল্যাম্পপোষ্টের আলো ভেদ করে তার চোখেমুখের তীব্র এক আলো আমাদের দূরত্ব কমিয়ে দিয়েছে। আমার অনুমতির উপেক্ষা না করেই টিফিনবক্স হাতে নিতে নিতে বলল,
-চলেন আফা
খুপড়িটা ঠিক ছোট কিনা জানিনা, কিন্তু অতি ক্ষুদ্র। নিজের উচ্চতার তিনগুণ নিচু হয়ে ঢুকতে হয় খুপড়িতে। চটের বিছানার একপাশে রোগা একজন পুরুষ শুয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরপর তিনি কঁকিয়ে উঠছেন। আমাকে দেখে তার ভিন্ন কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। ব্যস্ত শহরে তারাও বেশ ব্যস্ত মানুষ। বাদামওয়ালা ছেলেটা রোগা লোকটার কাছে গিয়ে বসতেই তিনি তাকে হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিলেন। লোকটার চোখের কোণায় পানি চিকচিক করছে। আমি বুঝতে পারলাম নিজের অবস্থান থেকে তিনি অক্ষম কিন্তু ভালবাসার দিক থেকে তিনি সবার উপরে।
হাজার কিংবা শতক না হলেও বেশকিছু তালি দেওয়া শাড়ি পরিহিতা ছেলেটার মা খুপড়িতে ঢুকে একটু অবাকই হলেন আমাকে দেখে। ছেলেটাকে ইশারায় জিজ্ঞাসা করার আগেই আমি গিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। “মা” নামক মানুষগুলোর শরীরে আলাদা একটা গন্ধ থাকে। ছোটবেলায় যখন বাবাকে মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করতাম, বাবা মায়ের শাড়িটা এনে আমার হাতে দিত। নিজের চোখের পানি খুব যত্ন করে আটকে রেখে আমার মাথায় হাত রেখে বলত, তোর মা নাই কিন্তু মায়ের শরীরের গন্ধটা কিছুটা হলেও আছে। মা জিনিষটাই আলাদা বুঝলি? মানুষ যতই বলুক আমি তোর বাবা, আমিই তোর মা। আসলে মায়ের অভাব কখনও বাবা দিয়ে পূরণ হয়নারে মা। তোকে মিথ্যা বলে কি লাভ? তোর মা'কে তো এনে দিতে পারব না।
রাত বাড়ার সাথে সাথে এ শহরের কোলাহল বাড়ে। ব্যস্ত মানুগুলো ঘরে ফিরে আসে। প্রিয়জনের কাছে আবদারের পাল্লা ভারী হয়। কোলাহল বাড়ে, ব্যস্ত মানুষগুলোর চাহিদাও বাড়ে। ল্যাম্পপোষ্টের আলোতে আমার রান্না করে আনা খাবারে আমি তিনজন ক্ষুধার্ত মানুষের তৃপ্তির ভোজন দেখলাম মন খুলে। হালকা মিষ্টি বাতাসে চারিদিক ছুঁয়ে যাচ্ছিলো বারবার।
খাওয়া শেষে বাচ্চা ছেলেটা তার বাবার সাথে শুয়ে গেল। মশার কামড়ে ছেলেটা কিছুক্ষণ পরপর কেঁপে উঠছিল। বাবার নাড়াচাড়া করার স্বল্প ক্ষমতা দিয়েই তিনি তার ছেলেকে মশার কামড় থেকে রক্ষা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বাবার চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো৷ দুইদিনের পরিচিত এক ছেলের জন্য বিনা প্রয়োজনেও এই যান্ত্রিক শহরে পড়ে থাকি আমি। সামান্য আবেগের বাঁধনে সত্যিকারের মায়া ছেড়ে পড়ে আছি এই ইটপাথরের স্বার্থপর দুনিয়ায়।
মোবাইলের ভাইব্রেশনের আওয়াজ বাড়ছে। সোহান কল দিচ্ছে। আমি রিসিভ না করেই খুপড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। ল্যাম্পপোষ্টের আলোতে সারা শহর আলোকিত হয়ে আছে। হুট করেই চারপাশের আলোগুলো নিভে গেল। লোডশেডিং নাকি যান্ত্রিক ত্রুটি বুঝার চেষ্টা করলাম না। আমার মনের অন্ধকারের কোণায় জ্বলে থাকা আলোতে আমি দিব্যি এগিয়ে যাচ্ছি বাসস্ট্যান্ডের দিকে।
সোহান ম্যাসেজ পাঠিয়েছে,”সরি ইরা সকালের ব্যবহারের জন্য। প্লিজ একদম মন খারাপ করবেনা। আমি এক্ষুনি তোমার মেসের সামনে আসছি রেডি থাকো। তোমার জন্মদিনের বাকিটা সময় আমরা খুব ভালোভাবে কাটাব।”
সোহান ম্যাসেজ পাঠিয়েছে,”সরি ইরা সকালের ব্যবহারের জন্য। প্লিজ একদম মন খারাপ করবেনা। আমি এক্ষুনি তোমার মেসের সামনে আসছি রেডি থাকো। তোমার জন্মদিনের বাকিটা সময় আমরা খুব ভালোভাবে কাটাব।”
মুচকি হাসি দিয়ে বাবাকে কল দিলাম৷ বাবা রিসিভ করেই বলল, শুভ জন্মদিন মা। কতগুলো কল দিলাম সারাদিন, বন্ধুদের সাথে ব্যস্ত ছিলি বুঝি?
কোনো উত্তর না দিয়ে বাবাকে বললাম, ফ্রিজ থেকে চিংড়িটা বের করে রাখো বাবা। আজ রাতের বাসেই আমি তোমার কাছে ফিরছি।
কোনো উত্তর না দিয়ে বাবাকে বললাম, ফ্রিজ থেকে চিংড়িটা বের করে রাখো বাবা। আজ রাতের বাসেই আমি তোমার কাছে ফিরছি।
Suma Mony
কোন মন্তব্য নেই