রূপবতী অবন্তী

রূপবতী অবন্তী

স্কুল জীবনে আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারি নি। শুদ্ধরূপে কথা বলবো! তাও হয় নি। খুব দ্রুত কথা বলার জন্য তোতলামি করতাম। অস্পষ্ট কথা যেনো নিত্যদিনের সঙ্গী।
তখন আমার অনেক কিছু ই ছিলো না। মায়াবী চেহারা। মেধাবী মস্তিষ্ক। সুন্দর হাতের লেখা। স্মার্টনেস। সুঠাম দেহ। কোনো কিছুই না।
যে জন্য স্কুল জীবনে আমার গার্লফ্রেন্ড ছিলো না।কাছের সকল বন্ধুর গার্লফ্রেন্ড ছিলো। ও রা প্রেম করতো। আহা! কত সুন্দর তাদের দুষ্টু মিষ্টি প্রেম। প্রেম শেষে কেউ কেউ ছ্যাঁকা খেয়ে বেঁকাও হয়ে যেতো।
কলেজে উঠার সময় আমি গুছিয়ে কথা বলতে শিখি। হাতের লেখা সুন্দর হয়। মেধাবী হই। স্মার্টনেস চলে আসে। ব্যায়ামের মাধ্যমে সুঠাম দেহ তৈরি করি। ধীরে ধীরে চেহারার মধ্য একটা মায়াবী ভাব চলে আসে।
কলেজে উঠতে না উঠতেই আমার গার্লফ্রেন্ড হয়।
বেশ সুন্দরী গার্লফ্রেন্ড। কিছুদিনের মধ্যেই প্রেম মাখো মাখো হয়। ঘুরাঘুরি। আড্ডা। লং ড্রাইভ। আদর সোহাগ। সব কিছুই চলতে থাকে।
দিন যায়। বন্ধুবান্ধব বৃদ্ধি পায়। বৃদ্ধি পেতে থাকে গার্লফ্রেন্ড সংখ্যাও। মেয়েদের ইম্প্রেজ করতে ভালো লাগে। প্রতিটি প্রপোজ যেন এক একটি গল্প।
কলেজ লাইফ শেষ করে ভার্সিটিতে ভর্তি হই। টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়টা'র প্রতি একটা আলাদা ভালোবাসা কাজ করতো। পড়তে থাকি। রেজাল্ট ভালো হয়। ভালো একটা জবও হয়ে যায়।
একদিন বন্ধুবান্ধব নিয়ে গ্রামে ঘুরতে যাই। বেশ ভালো লাগছিল। হঠাৎ করে সুজন বলে উঠলো।
- দোস্ত একটা চ্যালেঞ্জ এক্সেপ্ট করবি।
‌ প্লীজ প্লীজ না করিস না। তোকে এক্সেপ্ট করতেই হবে।
- কি চ্যালেঞ্জ ??
- একটা মেয়েকে প্রপোজ করতে হবে। শুনেছি গ্রামের মেয়েদের ইম্প্রেজ করা যায় না। দেখি তুই পারিস কি না।
- হা হা হা। এই ব্যাপার। ওকে, এক্সেপ্ট করলাম।
আজকেই প্রপোজ করব। যে কয়দিন গ্রামে আছি প্রেমও করা যাবে।
- ঐ যে আসছে......
মেয়ে টিকে দেখামাত্র প্রেমের ভুত ইতিমধ্যেই পালিয়ে গেছে। ইচ্ছে হচ্ছে আমিও গ্রাম ছেড়ে ই পালিয়ে যাই। মেয়েটি একেবারেই সুন্দর না। কালো। মোটা। অগোছালো। বিশ্রী। খুব রাগ হচ্ছিল।
তবুও চ্যালেঞ্জ এক্সেপ্ট করায় প্রপোজ করলাম। নিজের সম্পর্কে স্বাভাবিক তথ্য দিলাম। প্রেমের প্রস্তাব দিলাম। মেয়েটি কান্না করতে করতে ছুটে পালিয়ে গেলো। ভিষন লজ্জা পেলাম।
গ্রামে আর এক মুহূর্তের জন্য থাকতে ইচ্ছে হলো না। তবুও থেকে গেলাম।
সমস্যা দেখা দিলো পরের দিন সকালে।
প্রপোজ করার সময় অজয় ভিডিও করছিলো। ভিডিও ফেসবুকে আপলোড করে দেওয়ায় মুহূর্তের মধ্যেই ভিডিও ভাইরাল হয়ে যায়।
ভিডিও চোখে পরে মেয়েটি'র বড় ভাইয়ের।
বড় ভাই সকালে বাসায় এসে চিল্লাচিল্লি শুরু করে। থ্রেট দিতে থাকে। মেয়েটির বাবা এলাকার চেয়ারম্যান। দ্রুত পুরো গ্রামে আমাদের খবর ছড়িয়ে যায়। আমরা সবাই ঘাবড়ে যাই। কি করব না করব কিছুই বুঝছিলাম না। আমাদের সকলের মোবাইল বাজেয়াপ্ত করে রাখা হয়।
ভিডিও ভাইরাল হওয়ায় মেয়ের মান সম্মান নিয়ে টানাটানি হবে। এই ভয়ে আমাদের দু'জন কে জোরপূর্বক বিয়ে দেওয়া হয়।
এতো সুন্দর সুন্দর গার্লফ্রেন্ড রেখে অবশেষে এই কুৎসিত মেয়েকে বিয়ে করতে হবে। কল্পনাও করতে পারি নি।
বাসর রাতে মেয়েটির সাথে কথা বলি নি। আলাদা বিছানা করে ঘুমানোর আগে শুধু নাম জিজ্ঞেস করছিলাম। বেশ সুন্দর নাম। অবন্তী।
ভোরবেলা ঘুম ভাঙ্গতেই দেখি অবন্তী ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে দেখছে। ভেজা চুলে পিঠের অনেকাংশই ভিজে ছিপছিপে আছে। মেয়েটির জন্য কোনো মায়া কাজ করছে না। কেন করবে?
মেয়েটি কালো। মোটা। হাসি টাও সুন্দর না লেখাপড়াও তেমন করে নি। কোনোরকমে মেট্রিক পাশ করেছে। অশিক্ষিত। পুরোপুরি বিরক্তিকর ।
আমি ঘর থেকে বের হতেই চমকে গেলাম। এতোটুকুই বাকী ছিলো। আম্মু আব্বু শৈলী সবাই এখানে চলে এসেছে। ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ভিডিও, শৈলী আব্বু -আম্মুকে দেখিয়েছে। আর আমার ফোন বন্ধ পাওয়ায় খুঁজতে খুঁজতে এখান পর্যন্ত চলে এসেছে। দূর্ভাগ্য। আমার পরিবারের কেউ আমার পাশে নেই। সবাই মেয়েটির পক্ষেই কথা বলছে।
সবশেষে আমরা অবন্তীকে সাথে নিয়েই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। কয়েক ঘন্টা'র মধ্যেই ঢাকা চলে এলাম। নিজের খুব চেনা ঢাকাকে অচেনা লাগছে। অচেনা লাগছে নিজের সদ্য প্রাক্তন হওয়া গার্লফ্রেন্ড গুলো কে।
কখনো কারো থেকে ছ্যাঁকা খাইনি। বিভিন্ন কারনে ছ্যাঁকা দেওয়ার অভ্যাস ছিলো। দিয়েছি। তবে এবার যে সবাই কে এভাবে ছ্যাঁকা দিতে হবে ভাবি নি।
দিনের পর দিন চলে যায়। পেরিয়ে যায় মাস। তবুও অবন্তী কে স্পর্শ করা হয় না। ভালো লাগে না একেবারেই। বন্ধুবান্ধবের সাথেই সময় কেটে যাচ্ছিলো।
সেদিন টিভির দিকে হঠাৎ চোখ পরলো। অবন্তী খুব মনোযোগ দিয়ে একটি ছবি দেখছে। ম্যাডাম ফুলি। ছবির নায়িকা শিমলা ও অবন্তী 'র মধ্যে প্রচন্ড মিল। অবন্তী সত্যিই বোকা। মনে মনে হয়তো নিজে কে শিমলা ভাবছে। ও হয়তো জানেই না বাস্তবতা আর ছায়াছবি সম্পূর্ণ ভিন্ন। একটি সামান্য গল্প। অন্যটি নির্মম বাস্তবতা।
তবুও সেদিন রাতে ঘুম আসেনি, ম্যাডাম ফুলি ছবিটির কাহিনী মাথায় ঘুরছে। সত্যিই কি আদৌ কাউকে নতুনভাবে গড়ে তোলা যায়! সাজিয়ে গুছিয়ে নেওয়া যায়! গল্প আর বাস্তবতা কি আদৌ এক হয়??
অবশেষে স্বীদ্ধান্ত নিলাম। আমি অবন্তী কে সমাজের যোগ্য হিসাবেই প্রতিষ্ঠা করব। সৌন্দর্য। শিক্ষা। আচরণ। সব কিছুই আপেক্ষিক।
অবন্তী কে আমি নিজে লেখাপড়া শিখাতে শুরু করলাম। বিউটি এক্সপার্ট নিয়োগ দিলাম। অবন্তী 'র শেখার আগ্রহ খুবই ভালো। শিখতে শুরু করলো।
সৌন্দর্য্য। জ্ঞান পিপাসা। স্বাস্থ্য সচেতনতা। সব কিছুই দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। উন্নতি দেখে অবন্তীকে কলেজে ভর্তি করে দিই। নিয়মিত ক্লাস করে। পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো হয়।
একটা সময় অবন্তী ইংরেজিতে ঠিকমতো রিডিং পড়তে পারতো না। শুদ্ধ করে কথা বলতে পারতো না। মেট্রিক পরীক্ষায় টেনেটুনে জিপিএ ৩.০০ পেয়েছিল। সেই মেয়ে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় জিপিএ ৫.০০ পায়।
সৌন্দর্য্য! রূপে গুনে ইদানীং যেন অবন্তী'র শরীরে আগুন ঝরে। সেদিনের কালো, মোটা, কুৎসিত মেয়েটি আজ শ্যাম বর্নের অতুলনীয় সৌন্দর্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ । প্রচন্ড মায়া মাখা চাউনি। স্লিম। রূপবতী। অতুলনীয়।
আমার এযাবৎ কালের দেখা সব'চে রূপবতী মেয়েই অবন্তী। এবং মেধাবী। আই এল টি এস পরীক্ষায় ১০ এর মধ্যে ৯ পেয়ে আমাকেই চমকে দেয়। সত্যিই চমকে যাই। থমকে যেতে বাধ্য হই ও'র সফলতার কাছে।
অবন্তী 'র সৌন্দর্য্য ছিলো না বলে, বিগত দু'বছর আমি অবন্তী কে স্পর্শ করিনি। আদর করিনি। কাছে যাই নি।
অশ্রুসিক্ত চোখে প্রায়ই চুপচাপ জানালার গ্রিলের সামনে বসে থাকা মেয়েটির ভালোবাসা আমি বুঝিনি। সত্যিই নিজেকে অপরাধী লাগছে।
অবন্তী এই কথাগুলো কখনো কাউকে বলে নি। এবং আমার ছোটো বোন শৈলী কে পর্যন্ত বুজতে দেয় নি। অথচ শৈলী অবন্তী 'র অনেক ভালো বন্ধু।
আমি অবন্তী 'র প্রেমে পরে যাই। সত্যিই সত্যিই অবন্তী কে ভালোবেসে ফেলি। হৃদয়ের মধ্যমনিতে অবন্তী 'র জন্য একটা কুড়ে ঘর তৈরি করি।
স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। অবন্তী 'র সাথে আগামী দিন গুলো থাকবো। প্রায় দু'জনে আড্ডা দিবো। বারান্দায় দু কাপ কফি রেখে পাশাপাশি দু'জন বসে থাকবো। আদর করব। সোহাগ করব। আমার অবন্তীকে খুব যত্নে আগলে রাখবো।
আমাদের সন্তান হবে। সন্তান কে খুব যত্নে মানুষ করব। লেখাপড়া শিখাবো। কতকিছু ভাবছি।
হয়তো এটাই আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা।
আমি অবন্তী কে নতুনভাবে আবারো বিয়ে করতে চাই। সবাইকে দেখাতে চাই আমার রূপবতী - গুনবতী স্ত্রী কে। সমাজের সামনে আজ অবন্তী কে নিয়ে মাথা উঁচু করেই থাকা যায়।
বন্ধুবান্ধব সবাইকে বাসায় আসতে বললাম আত্মীয়স্বজন সবাই কে দাওয়াত দিলাম। সাথে দাওয়াত দিলাম অবন্তী 'র পরিবার কে।
বি গত দু'বছর অবন্তী 'র পরিবারের সাথে আমাদের যোগাযোগ ছিলো না। অবন্তীও কখনো গ্রামে ঘুরতে যাওয়ায় বায়না ধরে নি। অবন্তী 'র পরিবারও ঢাকায় আমাদের বাড়ি আসে নি। কারো সাথেই যোগাযোগটা আর হয়ে উঠেনি।
আগামীকাল বিয়ে হবে। এই চিন্তা তে রাতে তেমন একটা ঘুম আসছিলো না। তবুও ঘুমিয়ে গেলাম।
ভোরবেলা উঠে অবন্তী কে কোথাও খুঁজে পেলাম না। শৈলী কে জিজ্ঞেস করলাম। সেও জানে না।
হুট করে ড্রেসিংটেবিলের দিকে তাকালাম। একটি ডিভোর্স লেটার। অবন্তী'র দু'বছর আগের কুৎসিত ও এখনকার রূপবতী চেহারার দু'টো ছবি। এবং অশ্রুজলে ভিজে যাওয়া একটি চিঠি পরে আছে।
চলবে 


নাইম ইসলাম শুভ

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.