স্যারের ভালোবাসা


স্যারের ভালোবাসা

কলেজে আজ প্রথম ক্লাস। বিশ থেকে পঁচিশজনই সিভিল ড্রেসে এসেছে। গতরাতে যখন টেলর বলল, ড্রেস আজ রাতে বানাতে পারব কি না সিউর না, তখন হতাশ হয়ে ভাবতে হল, কাল প্রথম ক্লাসটা সিভিল ড্রেসেই যেতে হবে। কিন্তু সকাল সকালই ড্রেস বানানো হয়ে গিয়েছিল।
আমি ড্রেস পরে ফিটফাট হয়ে ক্লাসে এসেছি। সেকেন্ড পিরিয়ডে প্রিন্সিপ্যাল স্যার এসে হাজির। রাগী রাগী চাউনি, দ্যাখলেই মনে হয়, ঝগড়া করতে এসেছে।তিনি দু'হাত পিছনে মুষ্টিবদ্ধ করে চোখেমুখে গাম্ভীর্যের ভাব বহাল রেখে পুরো ক্লাসরুম হাঁটছেন। হাঁটতে হাঁটতে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে আমার সামনে এলেন। আমি ভয়ে ভয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছি। আমি তো কোনও ভুল করি নি, তাহলে স্যার আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? ড্রেসও তো ঠিকঠাক পরে এসেছি।
স্যার রাগে কাঁপতে কাঁপতে আমার পাশের ছেলেটাকে বললেন, টিশার্ট পরে এসেছিস কেন? এটা কি পার্টি হচ্ছে? কলেজ পার্টি? ফার্স্ট দিন কলেজ ড্রেসে না আয়, ফর্মাল ড্রেস পরে এলেও তো হতো। আসছে...
এমন সময় হড়বড় করে ক্লাসে একটা ছেলে ঢুকল। চুলে মারাত্মক কার্ট!দু'পাশে আর পেছনে একেবারে ছেঁচে ফেলা হয়েছে, আর উপরের চুলগুলো দিয়ে কান ঢেকে ফেলছে। তার এমন আচরণে সবাই স্তব্ধ। প্রথম দিন এসেছেও সেকেন্ড পিরিয়ডে,তার উপর ক্লাস টিচার, সাথে কড়া প্রিন্সিপ্যাল স্যার রুমে বর্তমান ; অনুমতি নেয়ার প্রয়োজনও মনে করল না? তার ভাবখানা দ্যাখে মনে হচ্ছে, সে ক্লাসে এসেই সবাইকে ধন্য করেছে, অনুমতি তো আকাশের চাঁদ।প্রিন্সিপ্যাল স্যার তার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই, তুই ওখানেই দাঁড়িয়ে থাক।
ছেলেটা হতভম্ব হয়ে গেল। অবাকচোখে স্যারের দিকে তাকাল। তার তাকানোর ভঙ্গি দ্যাখে মনে হচ্ছে, সে চরম অপমানবোধ করেছে। স্যার কথাটা এভাবে না বললেও পারতেন। ভদ্রভাবে এভাবে বললেও হত,সাইডে পিছে ফাঁকা ফাঁকা, উপর দিয়ে ঝাঁকানাকা চুলের অধিকারী তুমি, দাঁড়াও বাবা। তোমার কষ্ট করে আসা লাগবে না, আমিই কষ্টকরে তোমার কাছে আসছি।
প্রিন্সিপ্যাল স্যার কষ্টকরে তার কাছে গেলেন। বললেন, কই থাকিস?
ঝিগাতলা।
ঝিগাতলায় নাপিত নাই?
আছে স্যার।
তাইলে চুল কাটাস না কেন?
ছেলে নিশ্চুপ।
প্রিন্সিপ্যাল স্যার কবির স্যারের দিকে তাকিয়ে বললেন,একে ক্রিমার দিয়ে ন্যাড়া করে দিলে কেমন হয়?
কবির স্যার বিনীতভাবে বললেন, খুব ভাল হয় স্যার।
কবির স্যারের এই অভ্যাসটা লক্ষ করলাম। প্রিন্সিপ্যাল স্যার যা বলবেন, তিনি সাথে সাথে বিনীতভাবে বলবেন, খুব ভাল হয় স্যার বা একদম ঠিক কথা বলেছেন স্যার, একেবারে মনের অন্তঃস্থলের কথা।
ছেলেটার চুল ধরে টেনে হিঁচড়ে তাকে ক্লাসরুম থেকে বের করে দেয়া হল। সেদিনই বুঝেছিলাম সাবধানে থাকতে হবে, প্রিন্সিপ্যাল স্যারকে দ্যাখলেই সরে পড়তে হবে।
কোনও কোনও দিন প্রিন্সিপ্যাল স্যার আমাদের ফিযিক্সের ক্লাস নিতেন। পুরো চল্লিশ মিনিটে কেউ কোনও কথা বলতো না। একবার স্যারের ক্লাসে আমি পাশের ছেলেটার সাথে কথা বলার সময় স্যার দ্যাখে ফেলেছিলেন। আমাকে ডাকলেন।আমি স্যারের সামনে মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। স্যার বললেন, কি নিয়ে এত আলোচনা করছিলি?
আমি মিনমিন করে বললাম, ফিফথ ডাইমেনশন আর টাইম ট্র্যাভেল এর সম্পর্ক নিয়ে।
স্যার অবাক হয়ে বললেন, সত্যি?
জি স্যার।
স্যার খুশি হয়ে বললেন, সিটে গিয়ে বয়।
আমি চলে এলাম। মিথ্যে একটা কথা বলে এসেছি। আমি জানি, স্যারের ফিযিক্সের প্রতি খুব দুর্বলতা কাজ করে। তার মতে, সবকিছুর শুরু ফিযিক্স থেকে। ঘুম থেকে উঠা হতে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত পুরাটাই নাকি ফিযিক্স! মানুষ যে বিয়ে করে এটাও নাকি চুম্বকের বিপরীতধর্মী আকর্ষণ থেকে প্রাপ্ত। মানুষের রক্তে রক্তে মিশে আছে এই ফিযিক্স। তার একমাত্র ছেলেকে তিনি কোনওভাবেই সায়েন্সে ভর্তি করাতে পারেন নি। কমার্সে ভর্তি হয়েও ছেলে মেট্রিকে তিনবার ফেল করেছে। এরপর তার আর পড়াশুনা করা হয় নি।
সেদিন আমরা স্যারের বাসায় গিয়েছিলাম ফিযিক্স বুঝতে। স্যার আমাদেরকে পড়াচ্ছিলেন, এমন সময় ছেলে এসে হাজির। 'আব্বা, খাবেন না?'
স্যার রেগে উঠে বললেন, দ্যাখছিস না, ফিযিক্স পড়াচ্ছি? সারাদিন খাওয়া নিয়ে পড়ে থাকিস? ফিযিক্স বুঝিস?
ছেলেটা মন খারাপ করে চলে গেল।স্যারেরও কিছুটা অনুশোচনা হতে লাগল। ছেলেটার সাথে এমন ব্যবহার না করলেও হতো আমাদের সামনে। অবশ্য করবেনও না কেন? তিনবার ফেল মেরেছে। কমার্সও বুঝল না, ফিযিক্সও বুঝল না। কিছুই বুঝল না, খাদ্য ব্যতীত।
মাঝেমাঝে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে লাইব্রেরিতে গিয়ে বসে থাকলেও প্রিন্সিপ্যাল স্যার চলে আসেন। রেগে বলেন, কি ক্লাস চলছে?
স্যার, বাঙলা।
, ফিযিক্স কোন পিরিয়ডে?
লাস্ট পিরিয়ডে স্যার।
আচ্ছা, মিস করবি না।
করব না স্যার।
স্যার থাকাকালীন কলেজ ফান্ডের একটাকাও এদিক সেদিক হয় নি। তার মতে, সৌরজগতের প্রত্যেকটা গ্রহ যেমন নির্দিষ্ট অবস্থানে আছে, এবং নির্দিষ্ট অবস্থানে থেকেই যেমন চক্রাকারে ঘুরছে, ঠিক তেমনি কলেজের টাকাও নিজ অবস্থানে থেকে নির্দিষ্ট কাজে ব্যয় হচ্ছে। এই টাকা অন্য খাতে ব্যয় হওয়া মানে বড়কোনও দুর্ঘটনার শিকার হওয়া।যেমনটা সৌরজগতে কোনও গ্রহ গতিপথ ভুল করলে ঘটবে। ঠিক না কবির সাহেব?
কবির স্যার মাথা নেড়ে বলেন, একদম ঠিক কথা স্যার। কোনও খুঁত নেই, সম্পূর্ণ নিখুঁত কথা।
আমি কলেজের প্রিন্সিপ্যাল। এই কলেজে আমার কথায় অনেক কিছু হয়, হবে। আমি নিজেই যদি কিছু টাকা মারি, তাহলে অন্য টিচাররাও মারতে চাইবে। সব টিচার টাকা মারলে কলেজ কই যাবে? ছাত্রদের টাকা না? কত কষ্ট করে তাদের বাবা টাকাগুলো দেয়। এখান থেকে কিছু মারলে নিজের কাছেও তো নিজের মুখ দ্যাখাতে লজ্জা লাগবে। কি কবির সাহেব, লজ্জা লাগবে না?
অবশ্যই লজ্জা লাগবে স্যার। বাসার সব আয়না ভেঙে ফেলা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না।
কয়েকটা ছাত্রকে আমি চিনি। তাদের কিছু পারিবারিক সমস্যা আছে। নিজে টিউশনি করে খরচ চালায়। ওই টাকা মেরে আমি নাহয় একটা গাড়ি কিনলাম। কিন্তু কবির সাহেব, আপনিই বলুন, অই গাড়ি করে ড্রাইভিং এর সময় নিজের ভেতর কি সামান্যতম অপরাধবোধও কাজ করবে না?
কবির স্যার দ্রুত মাথা নেড়ে বললেন, প্রচন্ড অপরাধবোধ কাজ করবে স্যার। প্রতি সেকেন্ডে মনে হবে এই বুঝি এক্সিডেন্ট করব। এই বুঝি আমার এক্সিডেন্ট করা উচিত।
প্রিন্সিপ্যাল স্যার হাসলেন। হেসেই বললেন, কবির সাহেব, আপনি দারুণ বুদ্ধিমান। আপনার সাথে কথা বলে মজা পাওয়া যায়।
কবির সাহেব লজ্জা পেয়ে গেলেন। মাথানিচু করে মিটিমিটি হেসে বললেন, সবই আল্লা পাকের অশেষ মেহেরবানী।
.
অনেকদিন পর স্যারের বাসায় গেলাম। ভেবে রেখেছিলাম, পরীক্ষার রেজাল্ট যাই হোক, রেজাল্টের দিন স্যারের বাসায় যাব। মিষ্টি নিয়ে স্যারের বাসায় এলাম।স্যারের চোখেমুখে রাগের চিহ্নও নেই। স্যারকে আমার কলেজ জীবনে শুধু দু'বার হাসতে দ্যাখেছি। এছাড়া সবসময় তিনি রাগী রাগীই থাকেন। তবে আজ তার চোখেমুখে রাজ্যের অস্থিরতা। তিনি একটা মহিলার কাঠের মূর্তির হাত ঠিক করছেন। স্যারের চোখেমুখে ঘাম। চাউনিতে অস্থিরতা। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, স্যার?
স্যার জবাব না দিয়ে ব্যস্তভাবে কাঠের মূর্তির হাত লাগাচ্ছেন। আমি স্যারের ছেলে হাবীবের দিকে অসহায়মুখে তাকলাম।হাবীব বলল, আম্মা মারা গেছে গতবছর। আম্মার মৃত্যুর পর বাবা আম্মার একটা কাঠের মূর্তি বানায়। ফিযিক্সের কোনও সূত্র মেনে নাকি বানাইছে আল্লাই জানে। গতকাল একটা হাত হঠাৎ ভেঙে গেছে। রাত থেকেই বাবা সেটা জোড়া লাগানোর চেষ্টা করছেন,কোনওভাবেই জোড়া লাগছে না। বাবা নাছোড়বান্দার মতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। রাত থেকে কিছুই খান নি।
আমি স্যারের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। স্যার ঝরঝর করে ঘামছেন। মূর্তিটা বানানোর জন্য তিনি আত্মঘাতী হয়ে উঠেছেন। যেকোনওভাবেই হোক, তিনি এটা ঠিক করেই ছাড়বেন। আমি মনে মনে ভাবছি, কতটা রাগী হলে তাকে ভালবাসার মানুষ বলা যায়...?


Imran Hossain Emu

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.