সুলেখা


সুলেখা


Image result for Sulekha


লোকটার নাম রহমত মিঞা। বয়স পঞ্চাশ বছরের কম হবে না দেখলে মনে হয় এখনো শরীরে প্রচণ্ড জোর আছে। দিব্যি পরিশ্রম করে খেতে পারবেন। তবে কেন আমাদের কলেজ গেটের উত্তর প্বার্শে দাড়িয়ে থাকা বটগাছটার নিচে বসে ভিক্ষে করেন তা জানিনা। নিয়ে আজ অবধি কেউ কোন প্রশ্ন তুলেনি। লোক মুখে শুনেছি দশ বছর যাবৎ রহমত মিঞা এখানে বসে ভিক্ষে করেন। আজ খুব তাড়াহুড়া করে কলেজ ক্যাম্পাসে প্রবেশ করছিলাম। এমন সময় রহমত মিঞা পিছন থেকে ডাক দিলেন, অনেকটা বিরক্ত হয়ে পিছনে ফিরে তাকালাম। লোকটি বললেন,
---বাবা বিশটা টাকা হবে।

কোন কথা না বলে খুব দ্রুত পকেট থেকে বিশ টাকার একটা নোট বের করে লোকটার হাতে দিয়ে আবার পা বাড়ালাম।
---বাবা তোমার নাম কি...?

এবার খুব বিরক্ত হলাম বটে, চোখ মুখে বিরক্তের প্রকাশ দেখে রহমত মিঞা কিছুটা ভড়কে গেলেন। নীজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
----রহমত চাচা আমার পরীক্ষা আছে। এখন সময় নেই। আজ বিকেলে ফ্রি আছি। তখন গল্প করা যাবে।

রহমত মিঞা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন। তার চোখে মুখে কিছুটা আশ্চর্য হবার আবাশ পেলাম। হয়তো, রহমত মিঞার সাথে এভাবে ফ্রি সময়ে গল্প করাতো দূরের কথা কোন দিন আমার মত কেউ গল্প করার আশ্বাস দেয়নি। হয়তো আমিই এই প্রথম।
*******
আজ বিকেলটা খুক মেঘাচ্ছন্ন। রুম থেকে বেরুতে একদম ইচ্ছা করছে না।যেহেতু রহমত মিঞার সাথে গল্প করে বিকেলের এই ফ্রি সময়টা অতিবাহিত করার কথা তাই রিকশা চেপে কলেজ গেটে এসে নামলাম।নামার সাথে সাথে টিপটিপ বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। তাড়াতাড়ি রিকশা ভাড়া চুকিয়ে রহমত মিঞার আস্তানায় গিয়ে উঠলাম। উপরে বটের লতাপাতা থাকায় খানটায় তেমন বৃষ্টি পড়ছে না। রহমত মিঞা আমাকে দেখে হাঁসার চেষ্টা করলেন কিন্তুু তার দাড়ি ভর্তি মুখে হাঁসি প্রকাশ করতে পারলেন না। আমি "আসসালামু আলাইকুম"
বলে হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। লোকটা খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমার হাতে হাত মিলিয়ে সালামের জবাব দিলেন। সালামের জবাব দেবার ভঙ্গিটা দেখে তাকে ভিক্ষুক ভাবতে বড় কষ্ট হল বরং বড় উচ্চ স্তরের শিক্ষিত মানুষ ভাবতে কোন প্রকার সংকোচ হল না।
---কেমন আছো বাবা।

---এইতো ভালো

---আমি ভেবেছিলাম তুমি আসবে না

---কেন...?

---ভিক্ষুকের সাথে কেউ দেখা করতে আসে, কথা তোমাকে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।

--- কেউ না আসুক আমি আসি। কথাটির সাথে সামান্য অহংকার মিশ্রিত ছিল, হয়তো কথা ভেবেই লোকটা একটু হাঁসলেন, তারপর আমার দিকে তাঁকিয়ে বললেন,

---বাবা তোমার নামটাতো বললে না

---আমার নাম সামিউল

---বাহ! খুব সুন্দর নাম।

---জ্বি

ইতিমধ্যে বৃষ্টির বেগ অনেকটা বেড়ে গেছে বটের লতাপাতা সে বেগ সামলাতে না পারার কারণে রহমত মিঞার আস্তানার কিছু কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ভিজে যাচ্ছিল। লোকটা এসব কিছু সামলাতে সামলাতে বললেন,
--- চল কোন চায়ের দোকানে যেয়ে বসি।

**********---****---***
লোকটার সাথে যত কথা বলছি ততই তাকে জানার আগ্রহ বেড়ে যাচ্ছে। খুব কৌতূহল নিয়ে চায়ের দোকানে গিয়ে বসলাম। রহমত মিঞা দু'টা চায়ের অডার দিয়ে আমার পাশে বসলেন। নীজের আত্মসম্মান বোধে কিছুটা আঘাত লাগছে, কিন্তু একটা ভিক্ষুক সম্পর্কে জানার আগ্রহের কাছে সেটা কিছুই মনে হল না। একটু একটু ভয়ও লাগছে। শুনেছি এদের সাথে বেশী মেশা ঠিয় নয়। পরে ভিষণ বিপদে ফেলে টাকা পয়সা হাতাতে পারে। লোকটা বলল,
---জানি আমার সাথে কথা বলতে খুব খারাপ লাগছে।

---না না মটেও লাগছে না।

---যাইহোক, তোমাকে আমার খুব ভালো লেগেছে। আজ থেকে তুমি আমার ছেলে।

কথাটা শুনে অন্তরের ভিতর ছি ছি ছি টা কেমন যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। কোন ভিক্ষুকের ছেলে হবার ইচ্ছা না থাকায় স্বাভাবিক। অনেক কষ্টে নীজেকে সামলে নিয় বললাম,
----আপনার ছেলে নেই।

----না বাবা

----দেখেন আমি আপনার সাথে কিছুটা সময় দিয়েছে তাই বলে আমাকে ছেলে বানাবেন এটা হতে পারে না।

কথাটা শুনে লোকটার মুখটা কালো হয়ে গেল
---কেন বাবা ভিক্ষুককে বাবা ভাবতে খুব কষ্ট হয় বুঝি

---হওয়াটাই স্বাভাবিক।

এবার সত্যিই কষ্টে লোকটার অন্তরটা হয়তো দুমড়ে মুচড়ে গেল। এসব লোককে এভাবে আদর দিয়ে মাথায় তুলা ঠিক না। লোকটার শরীরের থেকে দূর্গন্ধ বের হচ্ছিল। মনে হয় অনেকদিন গোসল করেননি। মানুষদের প্রতি আমার এত ঘৃণা ছিল না। কিন্তু আজ কেন ঘৃণায় শরীরটা কাটা দিয়ে উঠছে বুঝতে পারছিনা। কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছিনা রহমত মিঞাও একজন আমারি মত রক্ত মাংসে গড়া মানুষ। ইদানিং এতটা অহংকারে জর্জরিত হয়ে পড়েছি তা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারলাম।
এতক্ষণে চা চলে এসেছে। চা খেতে ইচ্ছা করছে না তারপরও চা হাতে নিলাম। রহমত মিঞা চায়ে চুমক দিয়ে নরম সুরে বললেন,
---বাবা তোমাকে একটা অনুরোধ করবো রাখবে।

আবার কি অনুরোধ করবে আল্লাই ভালো জানেন। খুব বিরক্ত মাখা কণ্ঠে বললাম,
--- কি বলেন...?

লোকটা কি যেন চিন্তা করলেন তারপর বললেন,
---আমার একটা মেয়ে আছে বড়ই সুন্দরী।

তুমি বিয়ে করবে বাবা।
এবার রাগে মাথাটা গরম হয়ে গেল। দোকান ভর্তি লোক না থাকলে আচ্ছা মত এমন কিছু বলতাম সারা জীবন মনে থাকত রহমত মিঞার। তা আর হলনা রাগ সামলে নিয়ে বললাম
---কি বলছেন এসব।

বলতে যা দেরী। দোকান ভর্তি লোকের সামনে লোকটা আমার পায়ের উপর হুড়মুড় করে পড়ে গেলেন। সন্তান হারা পিতার মত হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।
--- বাবা দয়া করে, না কর না। আমার মেয়েকে বিয়ে করলে তুমি ঠকবে না। অনেক ভালো মেয়ে।

আমি ভিষণ রকম কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লাম। লোকজন আমার অবস্থা দেখে হাঁসতে শুরু করল। কেউ কেউ বলতে লাগল,পড়েছে বেট্যা পাগলের হাতে।
লোকটা যে শুধু ভিক্ষুক নয় বড় ধরনের পাগল এটা জানার আর বাকি থাকল না লোকটা সম্পর্কে জানার আগ্রহ থেকে এভাবে অপমানকর অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে কখনও ভাবিনি।
পা থেকে হাত ছাড়িয়ে চায়ের কাপটা টেবিলের উপর রেখে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বললাম,
---আপনার মত ছোট লোকের সাথে মেশায় আমার ভূল হয়েছে। আপনাকে প্রথমে ভালো মনে করেছিলাম। কিন্তু আপনি যে এত মতলববাজ নোংরা প্রকৃতির লোক জানতাম না।

আমার এসব কথায় লোকটা কতটা কষ্ট পেতে পারে তার কোন হিসাব নিকাশ না করেই দুই কাপ চায়ের মূল্য চুকিয়ে হন হন করে দোকান থেকে বের হয়ে পড়লাম।
তখন অঝরে বৃষ্টি পড়ছিল। লোকটা পিছন থেকে ক্রমাগত ডাকতেই থাকল,
---বাবা এত বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে যেও না জ্বর আসবে। আমার সুলেখার খুব বিপদ। ওকে বিয়ে করে উদ্ধার কর বাবা।

******---****----****---***
বিকেলের এই ঘটনা সরারাত মাথার ভিতর ক্রমাগত চর্কির মত ঘুরতে লাগল। রহমত মিঞা কি আসলেই পাগল? সামান্য এক ঘণ্টার কথা বার্তায় লোকটা আমাকে এত আপন করে নিতে চায়ল কেন?নাকি টাকা হাতানোর কোন মতলব আছে?
আর যাইহোক না কেন এভাবে লোকটাকে বলা আমার ঠিক হয়নি। ক্ষমা চাওয়া উচিত। এরকম আরো অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে রাতটা প্রায় নির্ঘুম কেটে গেল। সকালে রহমত মিঞার কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য কলেজে গেলাম।
দেখি আস্তানা খালি। বটগাছটার নিচে রহমত মিঞাকে দেখতে পেলাম না। কলেজ মোড়ের সমস্ত দোকানসহ আরও অনেক জায়গায় তন্য তন্য করে খুঁজলাম। কোথায়ও পেলাম না। ক্ষমা না পাওয়া পর্যন্ত হয়ত শান্তি পাব না। আবার ভাবলাম ধুর কোন ভিক্ষুকের কাছে ক্ষমা চাওয়ার মানে হয়। আচ্ছা রহমত মিঞার কি আসলেই সুন্দরী মেয়ে আছে। মেয়েটির নাম সুলেখা। বেশ সুন্দর নাম।সুলেখার কি আসলেই বিপদ। সে বিপদ সামলানোর কাজেই কি রহমত মিঞা ব্যস্ত তাই আজ আস্তানায় আসতে পারেননি। তার মেয়ে সুলেখাকে একাই উদ্ধার করতে পারবেন না বলেয় কি আমাকে বিয়ে করতে বলেছিলেন। এসব চিন্তায় আমি ক্রমেই পাগল হওয়ার উপক্রম।
*****---****----***----*** পুরো এক সপ্তাহ হয়ে গেল রহমত মিঞাকে আস্তানায় ভিক্ষে করতে দেখা গেল না। এই বিশাল বটগাছটি তার সঙ্গী হারিয়ে ভিষণ বিরহ ব্যথায় ঝিম মেরে দাড়িয়ে আছে। এক সপ্তাহ ব্যাপি তন্য তন্য করে গোটা শহরে খোঁজাখুঁজি করার পর বটতলার বস্তিতে রহমত মিঞার বাড়ি খুজে পেলাম।কিভাবে খুঁজে পেলাম সে গল্পটা বলতে গেলে গল্পের পরিধি অনেক বড় হবে, তাই খুজে পাবার গল্পটা গোপন রাখায় উত্তম। ময়লা আবর্জনাপূর্ণ এই বস্তির হাজার বাড়ির ভিতর রহমত মিঞার ভাঙ্গা টিনের বাড়িটা খুজে বের করা সত্যিই অনেক কষ্টকর ছিল।

গুপ্তধন পেলে মানুষ যেমন আনন্দে আত্মহারা হেয়ে উঠে ঠিক সেরকম আনন্দে আমার মনটা আত্মহারা হয়ে উঠল। রহমত মিঞার দরজায় অনেকটা মন্রমুগ্ধের মত কড়া নাড়লাম। ভিতর থেকে কোন সাড়াশব্দ নেয়। টিনের দরজায় আবার গুটি কয়েক কড়ানাড়তেই একটা মেয়ের কণ্ঠ ভেসে আসল।
---কে বাহিরে? একটু দাড়ান।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই মেয়েটি দরজা খুলে দিল। মেয়েটির দুটি চোখ ছাড়া গোটা শরীর বোরকায় ঢাকা। চোখ দুটি হরিণ শাবকের মত আমার দিকে বিষ্ময়ে তাকিয়ে আছে। দেখে আরব্য উপন্যাসের নায়িকার মত মনে হচ্ছে।
---রহমত চাচা বাসায় আছেন...?

---ওনি আমার বাবা, এক সপ্তাহ হয়ে গেল মারা গেছেন।

খবরটা শুনে ধাক্কা খেলাম।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই বাবার মৃত্যুর খবরটা বলল মেয়েটি। অবাক হলাম। মেয়েটির নাকি অনেক বিপদ তার কোন লক্ষণ পেলাম না। রহমত মিঞা হয়ত খুব ধৈর্য্যের শিক্ষা দিয়েছেন মেয়েটিকে।
---- তোমার নাম সুলেখা?

---জ্বি, নাম জানলেন কিভাবে?উত্তরের অপেক্ষা না করে আবার বলল,

---আপনি কি সামিউল?

--- হ্যাঁ

---একটু দাড়ান।

মেয়েটি ঘরের ভিতরে যেয়ে কিছুক্ষণ পর একটা চারভাজ করে মোড়ানো কাগজ নিয়ে এসে আমার হাতে দিয়ে বলল,
--- এই চিঠিটা মৃত্যুর আগে বাবা আপনাকে লিখে গেছেন। আর আপনি ছাড়া অন্য কাউকে এটা পড়তে নিষেধ করেছেন।

কাপাঁ কাপাঁ হাতে কাগজটা মেলে ধরলাম চোখের সামনে।
" বাবা সামিউল। আমি জানি তুমি আমার কাছে ক্ষমা চায়তে যেভাবেই হক আমার বাড়িটা খুঁজে বের করবে। ভিক্ষুকের মেয়েকে বিয়ে করতে তোমার আত্মসম্মানে বাধবে সেটা ভালো করেই বুঝতে পারছি। তারপরও বলছি মৃত্যুর আগে মানুষ মিথ্যে বলে না। আমার মেয়ে সুলেখা অনেক সুন্দরী তারচেয়ে বড় কথা আমার মেয়ে পর্দাশীল,অনেক পড়াশোনা জানা মেয়ে। সুলেখার মুখটা এখনো সূর্যটাও দেখেনি সুলেখাকে বিয়ে করলে তুমি ঠকবে না। আমার মেয়ের কেউ নেয়। তার দেখাশুনার ভার তুমি যদি গ্রহণ কর তাহলে আমি কবর থেকে অনেক সুখি হব। তোমার পায়ে পড়ি সুলেখাকে বিয়ে কর। জীবনে মানুষের কাছে অনেক সাহায্য চেয়েছি, এটা তোমার কাছে আমার জীবনের শেষ চাওয়া। আমার মেয়ের দায়িত্ব তুমি নাও। আমি কেন ভিক্ষে করার পেশা জীবনে গ্রহণ করেছি তা সুলেখার কাছ থেকেই শুনে নিও। আর একটা কথা শুনে রাখ সুলেখা ভিক্ষুকের মেয়ে নয়। কোনদিন ভিক্ষার এক পয়সাও তার পেটে যায়নি।তোমরা সুখে থাকো।

ইতি, ভিক্ষুক রহমত চাচা।"
রহমত মিঞার লেখা আর সুলেখাকে রহস্যপূর্ণ মনে হলেও চোখের অশ্রু ধরে রাখতে পারিনি। কাগজটা পড়া শেষ করে সুলেখার চোখের দিকে তাকিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে বললাম,
---- সুলেখা বের হও।

সুলেখা আশ্চর্য হয়ে বলল,
---মানে!

কোন কিছু না বলেই কাগজটা সুলেখার হাতে দিয়ে বললাম,
--- পড়?

সুলেখা কাগজটা পড়া শেষ করে মাথা নিচুঁ করে দাড়িয়ে থাকল। হয়ত লজ্জা পেয়েছে
মেয়েটি। সুলেখার ফর্সা নরম হাত ধরে বস্তির বাহিরে আসলাম। তারপর কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করলাম। এখন আমাদের বিবাহিত জীবনের বয়স পাঁচ বছরে পা দিয়েছে। একটা ছেলে সন্তানের জনক হয়েছি আমরা। আসলেই সুলেখাকে বিয়ে করে আমি ঠকিনি। কেন ঠকিনি তার গল্পটাও বেশ রহস্যপূর্ণ।
( সমাপ্ত)



রাজ রাজ্জাক

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.