টিউশন সিরিজ
টিউশন সিরিজ
পার্কে ডেকে নিয়ে এসে ঠাস করে আমার দু'গালে দুই'চর বসিয়ে দিলো শাপলা ম্যাডাম।গাল ঘসতে ঘসতে বললাম,
আমি'তো চর খাওয়ার মতো কোনো কাজ করিনি ম্যাডাম, তাহলে আমাকে মারলেন কেন?
- shut up. আমি কোনো কথা বলতে চাইনা আপনার সাথে।
- কেন?
- Just Shut up man. আপনি আমার সাথে আর কখনো কথা বলার চেষ্টা করবেন না। আমরা আগে যেমন অচেনা ছিলাম। এখনো অচেনা আছি।
আর সারা জীবন অচেনা থাকবো।
এই বলে আমার জীবন থেকে চলে গেলো শাপলা ম্যাডাম।
আমি প্রায় সবই বুঝি,
অ্যাপ্লাইড ফিজিক্স বুঝি, নিউটনের লও বুঝি, মেডিকেল এথিকস্ বুঝি, কম্পিউটার ল্যাংগুয়েজ বুঝি,
এই পৃথিবীতে আমি যা বুঝিনা, তা হলো আমার শাপলা ম্যাডামের মন। আজ উনি আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন । কেন গেলেন আমি বুঝিনি।
.
খুব ভোরে অচেনা একটা নম্বর থেকে কল আসলো।
- হেলো কে বলছেন?
- স্যার আমি অরণী।
- জ্বি অরণী বলুন।
- স্যার আমি মিরপুর দশেই থাকি। আপনি কি আমাকে পড়াতে পারবেন স্যার?
- কোন ক্লাস, কোন বিষয় বিস্তারিত বলুন।
- ক্লাস নাইন, শুধু ইংরেজি পড়াতে হবে।
মনে মনে ভাবছি,
(আমার তো বাংলা আর অংক পড়িয়ে অভ্যাস। ইংরেজি কিভাবে পড়াবো? কিন্তু তবুও পড়াতে হবে। টাকার দরকার)
- ঠিকাছে অরণী আপনি ঠিকানা মেসেজ করে দিন। আমি গিয়ে কথা বলবো।
.
চাঁদনীর হাবভাব ইদানিং বড্ড বিভ্রান্তিকর লাগে। শাপলা ম্যাডাম ইংরেজি পড়ায় চাঁদনীকে।
আর আমি পড়াই অন্যান্য বিষয়।
চাঁদনীর মা আমাকে শুরুতেই ভাই বানিয়ে নিয়েছিলো। যাতে আমাদের টিউশনের গল্পটা ভবিষ্যৎে প্রেমের গল্পে পরিবর্তন হয়ে না যায়। এই যুগের মা'রাও অনেক সচেতন। নিজের সুন্দরী কন্যাকে কিভাবে ঝিনুকের মতো আগলে রাখতে হয় তা খুব ভাল করে জানে।
যদিও চাঁদনী অসম্ভব সুন্দরী। কিন্তু তবুও ওকে ভাগ্নি ডাকতে আমার কোনো আপত্তি নেই। মাস শেষে ভাল একটা বেতন দিচ্ছে চাঁদনীর বাবা। টিউশনটা হাঁতছাড়া করতে চাইনা।
.
চাঁদনীকে পড়াতে বসেছি। চাঁদনীর মা এসে চা দিয়ে চলে গেল।
চাঁদনী আজ অনেক সাজগোজ করেছে। ১৬ বছর বয়সী এই মেয়েটি এমনিতেই বেশ সুন্দরী। সামান্য সাঁজে ওর মধ্যে এক প্রকার অপ্সরীভাব চলে এসেছে।
চাঁদনীকে জিজ্ঞেস করলাম,
- আজ তোমাকে এতো আনন্দিত লাগছে কেন মা ?
- Sir, Don't call me "মা'.
- কেন?
- আমি কোন হিসেবে আপনার মা লাগি?
- ভাগ্নিকে মা ডাকা যায় না?
- স্যার আমি আপনার ভাগ্নি না।
- কিন্তু তোমার 'মা'তো আমাকে ভাই ডাকে।
- ডাকলে ডাকুক। আই ডোন্ট কেয়ার।
আমিও আপনাকে ভাইয়া ডাকবো।
- কেন?
- স্যার প্লিজ, সব কথায় কেন কেন করবেন না।
- ঠিকাছে। কিছুই ডাকতে হবে না। আমি তোমার হোম টিউটর, তুমি আমাকে স্যার ডাকবে।
- স্যার। একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
- হুম, করো।
- স্যার, আপনি শাপলা ম্যাডামকে ভালবাসেন?
- চাঁদনী পড়ার সময় এসমস্ত বিষয় নিয়ে কখনো আলচোনা করবেনা।
- প্লিজ স্যার বলুন। আমাকে জানতে হবে।
- কেন? তোমাকে জানতে হবে কেন?
- সেটা পরে বলবো। আগে বলুন, আপনি ওনাকে ভালবাসেন কিনা?
- আমি সবাইকে ভালবাসি চাঁদনী।
- আমি ঐ ভালবাসার কথা বলিনি, আপনি কখনো কি ম্যাডামকে "আই লাভ ইউ" বলেছেন?
- না।
- তার মানে আপনি উনাকে ওরকমভাবে ভালবাসেন না।
- আচ্ছা টপিক চেঞ্জ করো চাঁদনী।
- ওকে স্যার থ্যাংক ইউ।
.
রাতে মেসে গিয়ে খাবার খেয়ে শুয়ে পরেছি। কিন্তু মনের মধ্যে, কেমন জানি একটা রহস্যের লালবাঁতি জ্বলছে। রহস্যের কিনারা করতে পারলেই সবুজ বাঁতি জ্বলবে। অবশ্যই কোথাও একটা লুকোনো রহস্য আছে। চাঁদনী আমার কাছ থেকে কিছু লুকোনোর চেষ্টা করছে।
.
পরেরদিন চাঁদনীকে জিজ্ঞেস করলাম,
- আচ্ছা সত্যি করে একটা কথা বলবে চাঁদনী?
- জ্বি স্যার অবশ্যই।
- তুমি কি আমার কাছ থেকে কিছু লুকোচ্ছো? সত্যি বলবে। তুমি জানো আমি মিথ্যা অপছন্দ করি।
- স্যার আপনি রাগ করবেন না তো?
- না বলো।
- স্যার আমি শাপলা ম্যাডামকে ব্ল্যাকমেইল করেছি। যদি শাপলা ম্যাডাম আপনার সাথে নেক্সট টাইম কথা বলার চেষ্টা করে। তাহলে আমি আর উনার কাছে পড়বো না। আমি জানি, বাবা শাপলা ম্যাডামকে শুধু ইংরেজির জন্যই অনেক টাকা দেয়। আমার আত্মবিশ্বাস ছিলো, উনি টিউশনি বাঁচাতে আপনাকে ভুলে যাবে। উনি তাই করেছে।
- তুমি কি করে জানলে, উনি তাই করছে।
- স্যার সেদিন আমিও পার্কে বসেছিলাম। আপনাকে ফলো করছিলাম। আমি নিজের চোখে দেখেছি শাপলা ম্যাডাম আপনাকে চর মেরেছে।
- চাঁদনী তুমি এসব কেন করতে গেলে?
- আপনার এই কেন'র উত্তরটা আমি দিতে পারবো না স্যার।
- চাঁদনী, আমি আর কাল থেকে তোমাকে পড়াতে আসবো না।
- কেন স্যার?
- ছি চাঁদনী, এমন একটা নিচু কাজ তুমি করতে পারলে? একটা মেয়ের দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাকে এভাবে হেনোস্তা করা ঠিক হয়নি তোমার।
- আমি আর তোমাকে পড়াতে আসবো না।
- স্যার আপনি না আসলে আমি সুইসাইড করবো।
- প্লিজ চাঁদনী তুমি ম্যাডামের কাছে সরি বলবে। আর সরি না বলা অবধি তুমি আমার কাছ থেকে মাফ পাবে না।
.
কয়েকদিন পর,
আবার ভোর বেলা মোবাইল বাঁজছে। বিরক্ত হয়ে ফোন ধরলাম,
- হ্যালো কে?
- স্যার আজ একটু সময় হবে আপনার?
- আপনি কে?
- স্যার আমি অরণী ।
- এতো সকালে ফোন করেছো কেন?
- স্যার একটু নীলক্ষেত যাবো। কয়েকটা ইংরেজি বই কিনতে হবে। যদি আপনি আমার সাথে একটু যেতেন, তাহলে খুব উপকার হতো স্যার।
- ঠিকাছে যাবো দশটার পর কল দিও। এখন রাখো।
- না স্যার বিকেলে যাবো।
- কয়টায় ?
- ৪ টার পর।
.
ঘুম ভেঙে গেছে। এখন চোখ বুজে থাকলেও আর ঘুম আসবে না।
একটু পর আবার কল আসলো চাঁদনীর বাবার মোবাইল থেকে।
ফোন রিসিভ করে সালাম দিলাম,
- হ্যালো আসসালামু আলাইকুম।
- স্যার আমি চাঁদিনী বলছি।
- হ্যা চাঁদনী কি হয়েছে বলো। স্যার আজ একটু নীলক্ষেত যাবো কয়েকটা বই কিনতে হবে। আপনি কি আমার সাথে একটু যেতে পারবেন স্যার?
- আর কেউ নেই?
- না স্যার। শাপলা ম্যাডামকে বলেছিলাম। কিন্তু উনি রাজি হয়নি।
- ম্যাডামকে সরি বলেছো?
- না।
- কেন?
- আমরা হোম টিউটরকে কখনো সরি বলি না।
- চাঁদনী আমি তোমার সাথে যেতে পারবো না। বিকেলে আমি অন্য একজনের সাথে যাবো।
- আর পারলে ম্যাডামকে সরি বলে দিও। শাপলা ম্যাডাম খুবই ভাল মানুষ।
বাই ভাল থাকো।
.
বিকেলে অরণীকে নিয়ে নীলক্ষেতে। এতো বই দেখছে কিন্তু একটাও পছন্দ হচ্ছে ওর।
হঠাৎ অরণী আমার হাত ধরে বসল।
খুবই বিব্রত হয়ে বললাম,
- অরণী আমার হাতটা ছাড়ো।
- অরণী হাত ছাড়লো না। বরং আরো কাছে এসে শক্ত করে ধরল।
প্লিজ অরণী হাত ছাড়ো। মানুষ ভুল ভাববে।
- কোনো ভুল ভাববেনা স্যার। খুব বেশি হলে প্রেমিক প্রেমিকা ভাববে।
- Oroni, have you lost your mind?
I'm your home Tutor. not your boyfriend.
অরণী হাত ছেড়ে দিলো। কয়েকটা হাছামিছে বই কিনে বলল,
- স্যার চলুন কফি খাবো।
- কফি শপে গিয়েও অরণী এমন ভাব করতে লাগলো। নানান কথার ছুতো দিয়ে হাত ধরছে, হেসে হেসে কথা বলছে।
নেহাত টিউশনের মায়ায় জড়িয়ে আছি।
নইলে উঠে চলে যেতাম।
কফি শপ থেকে বেড়িয়ে অরণী বলছে, স্যার আর একটি কাজ বাকি আছে।
- কি কাজ?
- স্যার সামনেই একটা শপিংমল আছে। ছোট একটা জিনিস কেনার ছিলো। যদি কিছু মনে না করেন স্যার একটু যাবেন আমার সাথে? আপনি বড় ভাইয়ের মত আমার পাশে আছেন বলেই আমি সাহস করে এখানে সেখানে যেতে পারছি। নইলে মেয়ে মানুষ একা একা কোথাও যাওয়া যায় বলুন স্যার?
.
অরণীর মুখে বড় ভাই কথাটা শোনার পর দেহে যেন প্রান ফিরে পেলাম। মেয়েটি আমাকে বড় ভাই ভাবছে সুতরাং যাওয়াই যায়।
- ঠিকাছে অরণী চলো।
সামান্য একটা লিপ্সটিক কিনল অরণী। আর আমাকে একটা সাদা শার্ট কিনে দিয়ে বলল,
- স্যার বড়ভাই হিসেবে দিচ্ছি,প্লিজ।
- অরণীর কর্মকান্ড দেখে কিছুই বলতে পারিনি শুধু অবাক হয়েছি। মাত্র ১০ দিনেই মেয়েটা এতো ভালবাসছে আমাকে ভাবতেই অবাক লাগে ।
- নতুন শার্টটা নিজেই গায়ে পরিয়ে দিলো।
- আজ বহুদিন পর শাপলা ম্যাডামের কথা মনে পরছে। ম্যাডামও আমাকে এভাবেই ভালবাসতো।
রাতে অরণীকে একটা মেসেজ দিলাম
"থ্যাংক ইউ বোন "
.
পরেরদিন চাঁদনীকে পড়াতে গিয়ে দেখি। চাঁদনী ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছে।
চাঁদনীর কাছে গিয়ে বিনম্র গলায় বললাম,
কাঁদছ কেন চাঁদনী?
চাঁদনী কান্নার গতি আরো বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
- স্যার আপনি একটিবার বলতে পারলেন না, আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে। তাহলে কি আমি আপনাকে এতো ভালবাসতাম?
- চাঁদনী আমি তোমার কথা বুঝতে পারছিনা।
- আর ন্যাকামি করতে হবে না স্যার। আমি কাল সব দেখেছি। আপনি প্রেমিকার হাত ধরে বই কিনেছেন, কফি খেয়েছেন, তারপর আপনার প্রেমিকা আপনাকে একটা সাদা শার্টও কিনে দিলো। এই তো এই শার্টটাই, যেটা গায়ে দিয়ে আছেন এখন। আমি সব দেখে নিয়েছি স্যার।
- কিভাবে দেখলে?
স্যার, দুপুরের পর শাপলা ম্যাডাম ফোন করে বলল, চাঁদনী,বিকেলে আমি ফ্রি আছি। যদি নীলক্ষেত যাও তবে আমাকে নিয়ে যেতে পারো। ম্যাডামকে নিয়ে চারটার পর নীলক্ষেতে গেলাম। আমি বই দেখছি এমন সময় ম্যাডাম আমাকে ডাক দিয়ে বলল, চাঁদনী ঐ যে দেখো কত সুন্দর বেলুন। বেলুনের দিকে তাকাতেই আপনাকে দেখলাম একটা মেয়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। তারপর ম্যাডামের কথায় আপনাকে ফলো করেছি, এইটুকু বলে চাঁদনীর কান্না আরো বেড়ে গেলো।
কাঁদতে কাঁদতে বললো, আমি ম্যাডামকে নিয়ে কতো কি ভেবেছিলাম আর শেষে গিয়ে কি দেখতে হলো আমাকে। চাঁদনী ঘরের সিলিঙের দিকে তাকিয়ে উদাসী হয়ে বলছে শাপলা আপু, I love you. প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দিও আপু।
আমি বললাম,
- চাঁদনী প্লিজ আমার কথাটা একবার শোনো।
- আর কি কথা বলবেন স্যার?
আপনাকে বরং এখন থেকে মামা বলেই ডাকবো।
.
চাঁদনীকে পড়িয়ে আমি যখন বেড়িয়ে যাই তার কিচ্ছুক্ষন পরেই আবার শাপলা ওকে পড়াতে আসে। কিন্তু আজ আসছে না।
আমাকে অন্য মেয়ের সাথে দেখে তার নিজেরও বোধয় শরির খারাপ হয়েছে ।
ম্যাডামের জন্য অনেকক্ষন অপেক্ষা করলাম কিন্তু ম্যাডাম আসলোই না।
রাগ করে অরণীকে পড়াতে চলে গেলাম।
অরণীর ঘরে ঢুকতেই গা ঝাঁকি দিয়ে উঠলো আমার। শাপলা ম্যাডাম অরণীর খাটের উপর বাবু দিয়ে বসে আছে। আর চেয়ারে বসে আছে অরণী।
ম্যাডামকে দেখে আমার গলায় কথা আটকে গেছে।
শাপলা ম্যাডাম বললো,
- স্যার আমার বোনের চয়েজ কিন্তু একদম আমার মতো। আমি হলে ঠিক এই শার্টটাই কিনতাম আপনার জন্য।
- কিহ, অরনী আপনার বোন হয়?
- জ্বি স্যার, একদম মায়ের পেটের।
আমি মুচকি হেসে বললাম,
- ম্যাডাম এতো পরিকল্পনা করেছেন শুধু একটা টিউশনি বাচানোর জন্য?
- শুধু আমার টিউশনি বাঁচাইনি। আপনারটাও বাঁচিয়েছি। কারন ছাত্রীর সাথে প্রেম হলে সেই টিউশনি কখনো টিকে না।
- ম্যাডাম আপনি ঠিকই বলেছিলেন,
আপনার বুদ্ধির কাছে আমি সারাজীবনই অপরিচিত থেকে যাবো।
লেখকঃ নূর প্রদীপ্ত
কোন মন্তব্য নেই